বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ , কারণ, প্রতিরোধ এবং করণীয়

জলাতঙ্ক শুধুমাত্র কুকুরের রোগ নয় বিড়ালও এই মারাত্মক ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। অনেক সময় আমাদের প্রিয় পোষা বিড়ালটির আচরণে ছোট ছোট পরিবর্তন দেখা দেয়, যা আমরা উপেক্ষা করি। কিন্তু এই পরিবর্তনগুলোই হতে পারে জলাতঙ্কের প্রাথমিক লক্ষণ।

বিড়াল জলাতঙ্ক ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রথমদিকে খুব সাধারণ কিছু লক্ষণ দেখা যেতে পারে, যেমন আচরণে পরিবর্তন, অতিরিক্ত ভয় বা লুকিয়ে থাকা। ধীরে ধীরে এটি আরও গুরুতর আকার ধারণ করে। আক্রান্ত বিড়াল অস্বাভাবিকভাবে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে, বা কখনও অত্যন্ত শান্ত ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত লালায় ঝরা, গলায় অবশতা যার ফলে শব্দ করতে বা গিলতে কষ্ট হয়, খিঁচুনি বা চলাফেরায় অসংগতিপূর্ণ আচরণ দেখা যায়। রোগটি মস্তিষ্কে পৌঁছে গেলে এই লক্ষণগুলো আরও তীব্র হয় এবং শেষপর্যন্ত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।

জলাতঙ্ক রোগ আসলে কি ও কিভাবে ছড়ায় ?

  • জলাতঙ্ক রোগ হলো:- জলাতঙ্ক (Rabies) একটি মারাত্মক ভাইরাসজনিত রোগ, যা মূলত প্রাণী কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগটির জন্য দায়ী ভাইরাসটির নাম Rabies virus, যা Lyssavirus গণভুক্ত।
  • জলাতঙ্ক যেভাবে ছড়ায়:-জলাতঙ্ক ভাইরাস সংক্রমিত প্রাণীর লালা মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে এই রোগ হতে পারে।
  • সাধারণত সংক্রমিত প্রাণী যেমন কুকুর, বিড়াল, বাদুড়, শিয়াল ইত্যাদি কামড় দিলে বা আঁচড় দিলে ভাইরাসটি প্রবেশ করে।
  • এটি মানুষ থেকে মানুষে সাধারণভাবে ছড়ায় না।

জলাতঙ্ক রোগটি কিভাবে বিড়ালের শরীরে অ্যাটাক করে এবং কাজ করে?

জলাতঙ্ক (Rabies) শুধু কুকুর নয়, বিড়ালের শরীরেও আক্রমণ করতে পারে, এবং এটি একটি জীবনঘাতী ভাইরাসজনিত রোগ। এখন দেখা যাক, বিড়ালের শরীরে জলাতঙ্ক ভাইরাস কীভাবে প্রবেশ করে ও কিভাবে কাজ করে।

কীভাবে বিড়ালের শরীরে জলাতঙ্ক ভাইরাস প্রবেশ করে?

বিড়ালটি যদি: জলাতঙ্কে আক্রান্ত কোনো প্রাণীর কামড়ে পড়ে যেমন: কুকুর, বাদুড়, বা অন্য বন্য প্রাণী অথবা ভাইরাসবাহী প্রাণীর লালা তার ক্ষত বা চোখ/নাক/মুখের মিউকাস ঝিল্লিতে প্রবেশ করে, তাহলে বিড়ালের শরীরে Rabies virus প্রবেশ করতে পারে।

ভাইরাসটি বিড়ালের শরীরে কীভাবে কাজ করে?

১. ভাইরাসটি প্রথমে কামড়ের জায়গার আশেপাশের নার্ভে প্রবেশ করে।

২. তারপর তা ধীরে ধীরে স্নায়ুতন্ত্র ধরে মস্তিষ্কে চলে যায়। এই প্রক্রিয়া কিছুদিন সময় নেয় ২ সপ্তাহ থেকে ৩ মাস পর্যন্ত হতে পারে।

৩. মস্তিষ্কে পৌঁছানোর পর বিড়ালটির ব্যবহার ও আচরণে পরিবর্তন শুরু হয়, যেমন:

  • হিংস্রতা বা অস্বাভাবিক ভয়
  • খাওয়ার আচরণ পরিবর্তন
  • অতিরিক্ত লালা পড়া
  • পানির ভয়
  • পক্ষাঘাত

৪. একবার মস্তিষ্কে ভাইরাস পৌঁছে গেলে, বিড়ালটির মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত।

বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ?

জলাতঙ্ক রোগ একটি নীরব ঘাতক। বিড়ালের শরীরে একবার এই ভাইরাস প্রবেশ করলে প্রথমে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কিন্তু ভাইরাসটি যখন মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়, তখন আচরণে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা দেয়। প্রথমে বিড়ালটি অস্বাভাবিক শান্ত বা ভীতু হয়ে যেতে পারে। তারপর আচরণে আক্রমণাত্মক হিংস্রতা দেখা দিতে পারে। এমনকি, নিজের মালিক বা চেনা মানুষকেও কামড় দিতে পারে। অনেক সময় সে নিজের শরীর কামড়াতে শুরু করে।

যখন ভাইরাস গলায় প্রভাব ফেলে, তখন বিড়াল গিলতে পারে না, ফলে মুখ দিয়ে লালা পড়তে থাকে যা দেখতে ভয়ঙ্কর ও আশঙ্কাজনক। জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত বিড়ালের কিছু  লক্ষণ নিচে দেওয়া হলো :

১. প্রাথমিক লক্ষণ :

  • এই পর্যায়ে সাধারণ আচরণে হালকা পরিবর্তন দেখা দেয় (১-৩ দিন ধরে):
  • হঠাৎ খুব ভীত বা লাজুক হয়ে যাওয়া
  • অতিরিক্ত আসক্তি বা আগ্রাসন
  • সাধারণত নাক বা মুখ চাটতে থাকা
  • ক্ষুধা কমে যাওয়া বা অদ্ভুত জিনিস খাওয়ার চেষ্টা (যেমন পাথর, কাঠ)
  • চোখে অস্বাভাবিক দৃষ্টি, কিছু না থাকলেও তাকিয়ে থাকা

২. আগ্রাসী বা হিংস্র পর্যায় :

  • সব বিড়ালের মধ্যে না দেখা গেলেও, অনেক বিড়াল এ পর্যায়ে যায় (২-৪ দিন ধরে):
  • হঠাৎ আক্রমণাত্মক আচরণ
  • নিজের মালিক বা অন্য প্রাণীকে কামড়ানো
  • আচরণে অস্থিরতা বা উদভ্রান্ত ভাব
  • কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন 
  • আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা
  • পানির ভয় মুখের পেশিতে খিঁচুনি, পানি গিলতে না পারা

৩. পক্ষাঘাত পর্যায় :

  • এটা জলাতঙ্কের শেষ ও মারাত্মক পর্যায়
  • মুখ, জিহ্বা, গলা, ও পেছনের পায়ে পক্ষাঘাত
  • অতিরিক্ত লালা ঝরা 
  • মুখ দিয়ে ফেনা বের হওয়া
  • গিলতে না পারা
  • নিস্তেজ হয়ে যাওয়া
  • কোমায় চলে যাওয়া এবং মৃত্যু


বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের কারণ কি?

বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের মূল কারণ হলো Rabies virus, যা একটি Lyssavirus প্রজাতির ভাইরাস। এটি একটি নিউরোট্রপিক ভাইরাস, অর্থাৎ এটি স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণ করে এবং ধীরে ধীরে মস্তিষ্কে পৌঁছে মস্তিষ্ক ও নার্ভের কার্যক্রম নষ্ট করে দেয়। একবার মস্তিষ্কে পৌঁছালে এই ভাইরাস মারাত্মক ও প্রায় ১০০% প্রাণঘাতী হয়।

বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের প্রধান কারণসমূহ:-

1. জলাতঙ্কে আক্রান্ত প্রাণীর কামড়:-

  • সবচেয়ে সাধারণ কারণ। 
  • যদি একটি সংক্রমিত কুকুর, বিড়াল, বাদুড় বা বন্য প্রাণী বিড়ালটিকে কামড়ে দেয়, তবে ভাইরাসটি তার লালার মাধ্যমে বিড়ালের রক্তে প্রবেশ করে।

2.  আঁচড় বা খোলা ক্ষতের মাধ্যমে সংক্রমণ:-

  • যদি জলাতঙ্ক ভাইরাসবাহী প্রাণীর লালা বিড়ালের কোনো কাটা-ছেঁড়া বা ক্ষতস্থানে লেগে যায়, তাহলেও সংক্রমণ হতে পারে।

3.  বন্য ও অচেনা প্রাণীর সংস্পর্শ:-

  • যেসব বিড়াল বাইরে ঘোরাফেরা করে তারা রাস্তায় বা জঙ্গলে জলাতঙ্ক ভাইরাসবাহী প্রাণীর সংস্পর্শে এলে আক্রান্ত হতে পারে।


বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের প্রতিরোধ ?

বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগ একটি মারাত্মক ও প্রাণঘাতী রোগ হলেও সচেতনতা ও সঠিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এটি পুরোপুরি রোধ করা সম্ভব। জলাতঙ্ক প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো সময়মতো বিড়ালকে টিকা দেওয়া। সাধারণত বিড়ালের তিন মাস বয়সে প্রথম জলাতঙ্ক টিকা দেওয়া হয় এবং এরপর প্রতি বছর বা নির্দিষ্ট সময় অন্তর বুস্টার ডোজ দেওয়া উচিত।

 বিড়ালকে বাড়ির ভেতরে রাখা এবং অচেনা প্রাণী, বিশেষ করে রাস্তার কুকুর, বিড়াল বা বন্যপ্রাণীর সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাইরে ঘোরাঘুরি করলে বিড়ালের আক্রান্ত প্রাণীর সাথে সংঘর্ষের সম্ভাবনা থাকে, যার মাধ্যমে ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করতে পারে। যদি বিড়ালকে কোনো প্রাণী কামড়ায় বা আঁচড় দেয়, তাহলে দ্রুত সেই জায়গা সাবান ও পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে এবং পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বিড়ালের আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন, অতিরিক্ত লালা ঝরা বা হিংস্রতা দেখা গেলে দেরি না করে চিকিৎসা নেওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে, জলাতঙ্ক রোগে একবার লক্ষণ প্রকাশ পেলে তা আর প্রতিরোধ সম্ভব নয়, তাই সময়মতো টিকা ও সচেতনতাই এই ভয়াবহ রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়।


নিচে কিছু প্রতিরোধের উপায় দেও হলো :-
1. টিকা দেওয়া (Vaccination):
  • এটাই সবচেয়ে কার্যকর এবং বাধ্যতামূলক প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
  • সাধারণত বিড়ালের ৩ মাস বয়সে প্রথম জলাতঙ্ক টিকা দেওয়া হয়।
এরপর:
  • ১ বছর পরে বুস্টার ডোজ
  • তারপর প্রতি বছর বা ৩ বছর পরপর 

 টিকার নাম হতে পারে:
  • Nobivac Rabies
  • Rabigen
  • Rabvac

2.  বিড়ালকে ঘরের ভেতরে রাখা (Indoor cat):
  • বাইরে ঘোরাফেরা করলে বিড়ালের আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • ঘরের ভেতরে রাখলে সে বন্য বা রাস্তায় থাকা কুকুর, বিড়াল, বা বাদুড় থেকে নিরাপদ থাকে।
3.অচেনা প্রাণীর সংস্পর্শ এড়ানো:
  • বিড়ালকে বনে, রাস্তায়, বা যেখানে বন্যপ্রাণী ঘোরে — সেইসব জায়গায় না যেতে দেওয়া।
  • বাড়ির আশপাশে সন্দেহজনক বা আক্রমণাত্মক প্রাণী দেখলে প্রাণী নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে জানান।
4. জলাতঙ্কে আক্রান্ত প্রাণীর কামড় বা আঁচড় এড়ানো:
  • যদি বিড়ালকে কামড়ায় বা আঁচড় দেয় এমন প্রাণী, বিশেষ করে:
  • রাস্তার কুকুর বা বিড়াল
  • বাদুড়
  • শিয়াল 
  • তখন তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষত ধুয়ে দ্রুত ভেটেরিনারির কাছে যান।
5. টিকা সংক্রান্ত রেকর্ড রাখা:
  • বিড়ালের টিকা দেওয়ার তারিখ ও সময় সঠিকভাবে নথিভুক্ত রাখুন।
  • প্রয়োজনে ভেটেরিনারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে টিকা সনদপত্র  সংগ্রহ করুন।
6. মানুষের জন্য সচেতনতা:
  • যদি আপনার বিড়াল কাউকে কামড়ায় বা আঁচড় দেয়, তাহলে তাকে পর্যবেক্ষণে রাখুন এবং লোকটিকে ডাক্তার দেখাতে বলুন।
  • জলাতঙ্কে আক্রান্ত বিড়াল মানুষকেও সংক্রমিত করতে পারে।

বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের করণীয়

বিড়ালের জলাতঙ্ক রোগের করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা থাকা খুবই জরুরি, কারণ এটি একটি মারাত্মক এবং প্রাণঘাতী ভাইরাসজনিত রোগ। যদি কোনো বিড়াল আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন ঘটায় যেমন অতিরিক্ত হিংস্রতা অস্বাভাবিক ভয়, গলা দিয়ে লালা ঝরানো বা গিলতে অসুবিধা দেখা যায় তাহলে দ্রুত তাকে আলাদা করে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে এবং পশুচিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। যদি বিড়ালটি কোনো বন্য প্রাণী বা রাস্তার কুকুরের কামড়ে পড়ে তাহলে আক্রান্ত স্থানে দ্রুত সাবান ও পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে এবং যথাশীঘ্র সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। 

সন্দেহভাজন জলাতঙ্ক আক্রান্ত বিড়ালকে অন্য প্রাণী ও মানুষের থেকে দূরে রাখা উচিত যাতে ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি না থাকে। পাশাপাশি যেকোনো কামড় বা আঁচড় লাগলে মানুষকেও দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে। জলাতঙ্কের ক্ষেত্রে প্রতিরোধই সবচেয়ে বড় করণীয়, তাই বিড়ালকে নিয়মিত টিকা দেওয়া, টিকা কার্ড হালনাগাদ রাখা এবং বাইরে ঘোরাফেরা সীমিত করাই পারে এই রোগ থেকে আপনার পোষ্য এবং পরিবারকে নিরাপদ রাখতে। মনে রাখতে হবে একবার জলাতঙ্কের লক্ষণ দেখা দিলে তা আর নিরাময়যোগ্য নয় তাই সময়মতো সচেতন পদক্ষেপ নেওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আপনি নিবোর্ন সাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url